ঘটনা ২০২২ সালের। ইরানের বিপ্লব পুরো দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সারা বিশ্ব ইরান সরকারের প্রতি নিন্দা জানিয়েছিল। ছবি, ভিডিও, রিলসসহ সব বাস্তবিক চিত্র আর ঘটনাকে সারা বিশ্বের কাছে রাতারাতি পৌঁছে দিচ্ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। সরকার সেই সময় এই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপসহ শত শত নিউজ পোর্টাল এবং ওয়েবসাইট গণহারে বন্ধ করে দিল।
এ রকম অসংখ্য ঘটনাকে পুঁজি করে ইরানে আজ পর্যন্ত সব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর ফারসি ভাষার স্যাটোলাইট টিভি চ্যানেল ‘ইরান ইন্টারন্যাশনালের অনলাইনে ‘Iran To Continue Social Media Ban, Grant Access To Regime Insiders’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইরানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ টুইটার, টেলিগ্রামের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। পৃথিবীর এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হলো এআই প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে বর্তমান দুনিয়ায় এক আমূল পরিবর্তন শুরু হয়েছে। মানুষের পরিবর্তে রোবটিক্স কৃত্রিম জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। চিকিৎসা, শিক্ষা, গবেষণা থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে এআইয়ের ব্যবহার অতি লক্ষণীয়। দুনিয়া যেন ন্যানো সেকেন্ডের গতিতে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ইরানে এমন কোনো ওয়েবসাইট পাওয়া যাবে না, যা এআই দ্বারা পরিচালিত হয়। নিষিদ্ধ করার পেছনে অনেক কারণ থাকলে প্রধান কারণ হিসেবে আমেরিকাকেই ধরা হয়। কারণ এআই মূলত আমেরিকান প্রযুক্তি।
প্রশ্ন হলো, এত নিষেধাজ্ঞার পরও ইরানের সাধারণ নাগরিকরা কীভাবে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে? বিকল্প হিসেবে কী ব্যবহার করে থাকে তাদের প্রত্যাহিক জীবনে? ইরানে জাতীয় মিডিয়া সদর দপ্তরসহ সরকারের অফিসে ইন্টারনেটের ব্যবহার উন্মুক্ত। সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ যে কোনো ধরনের দেশি-বিদেশি সাইট অতি দ্রুতগতির নেটের সঙ্গে ব্যবহার করা যায়, সরকারিভাবে পুরো ইরানে নিষিদ্ধ থাকলেও।
এখানে প্রতিটি মানুষের মোবাইল ফোনে কিংবা কম্পিউটারে অন্ততপক্ষে আট থেকে দশ রকমের ভিপিএনের দেখা মেলে। এর কারণ হলো সব সময় সব ধরনের ভিপিএন একইভাবে কাজ করে না। প্রথমত নেটের গতি অনেক কম হওয়ায় কোনো ভিপিএনই দ্রুত সংযোগ নিতে পারে না, আর পেলেও প্রথম প্রথম তা ঠিকভাবে কাজ করে না। বাধ্য হয়ে পরবর্তী ভিপিএন-সংযোগ করতে হয়। এই জায়গাতে এসে বুঝেশুনে ধর্যের সঙ্গে ভিপিএন ব্যবহার করতে হয়। হাজার হাজার মানুষের দেখা মেলে, যাদের মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারে কোনো ফ্রি ভিপিএনই কাজ করে না। তারা বাধ্য হয়ে কিংবা পেশাগত কারণে প্রতি মাসে ইন্টারনেট প্যাকেজের মতো প্রিমিয়াম ভিপিএন প্যাকেজ ব্যবহার করে থাকে। আর সবচেয়ে মজার বিষয় হলো যখন ফোন বা কম্পিউটারে ভিপিএন সক্রিয় অবস্থায় থাকে, তখন ইরানের কোনো অভ্যন্তরীণ ওয়েবসাইট, অ্যাপ, নিউজ পোর্টালসহ যাবতীয় কোনো কিছুই ব্যবহার করা যায় না।
অর্থাৎ, কেউ যদি একটা বিশেষ কোানা গবেষণা বা বিশেষ কোনো কাজ বা প্রোজেক্ট ইরানে বসে করতে চায়, তাহলে প্রথমে তাকে ইরানি তথ্যের বা অভ্যন্তরীণ উেসর জন্য ভিপিএন বন্ধ করে সার্চ করতে হবে। ঠিক একইভাবে বিদেশি বা আন্তর্জাতিক কোনো তথ্যের জন্য পুনরায় ভিপিএন চালু করতে হবে। এই ভাবে গবেষণা আর কাজের পাশাপাশি ভিপিএন নিয়ে খেলা করতে হবে। আমি আসলেই জানি না যে, এই রকম বিড়ম্বনা দুনিয়ার অন্য কোনো দেশে আছে কি না!
আমি আমার থিসিসের জন্য যে বিষয়টা নিয়ে কাজ করছি, এর ৫০ শতাংশ কাজের পরিধি বাংলাদেশে আর বাকি ৫০ ইরানে। তাই কাজের সুবাদে আমাকে দুই দেশের তথ্যই সমানভাবে ব্যবহার করতে হয়। যখন আমি থিসিসের কাজ নিয়ে বসি, দুই ঘণ্টা এক্সট্রা সময় হাতে রাখতে হয় শুধু ভিপিএন চালু আর বন্ধ করার জন্য। এইভাবে ভিপিএনের সঙ্গে খেলা করতে করতে আমি আমার থিসিসের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এত সময় আর শ্রম নষ্ট হয় যে বলে শেষ করা যাবে না। এ ভাবেই প্রতিটি দিন ভিপিএনের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে ইরানের বসবাসরত সব মানুষকে।
ইরান নিজেদের আমেরিকাসহ বিশ্বের বড় বড় শক্তিধর দেশের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনে করে, নিজেদের কারো মুখাপেক্ষী বলে মনে করে না। তাই তারা আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেরাই কিছু অ্যাপ তৈরি করেছে। যেমন ‘হোয়াটসঅ্যাপ’ এবং ‘টেলিগ্রামের বিকল্প হিসেবে ‘ইটা’ বা ‘বালে’ নামক অ্যাপ ব্যবহার করা হয়। ইরানে ইনস্টাগ্রামের বিকল্প হিসেবে ‘রুবিকা’ অ্যাপটি ব্যবহার করা হয় এবং ‘ইউটিউবের বিকল্প হিসেবে ‘আপারত’ ব্যবহার করা হয়। এই রকম আরো অসংখ্য অ্যাপ তৈরি করেছে ইরান। সত্যি কথা বলতে, এগুলোও ব্যবহার করতে একদিকে যেমন কোনো ভিপিএনের প্রয়োজন পড়ে না, ঠিক তেমনি এগুলো চালু করার সঙ্গে সঙ্গেই ইন্টারনেটের গতি অনেক বেশি ওপর লেভেলে চলে যায়।
আসলে দেখার বিষয় যে, এগুলো দ্বারা মানুষ আসলেই উপকৃত হচ্ছে, নাকি অতিরিক্ত দম্ভের জোরে লোক হাসানো হচ্ছে। এই অ্যাপগুলো অধিকাংশেই অভ্যন্তরীণ অ্যাপ হিসেবে ব্যবহূত হয়, সে কারণে বাইরের দেশে এই অ্যাপগুলোর মাধ্যমে ফোন বা সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয় না। আর সবচেয়ে মজার বিষয় হলো যে, ইরানের শতকরা ১০ ভাগ মানুষও এগুলো ব্যবহার করে কি না সন্দেহ। একমাত্র যারা বাধ্য আর নিরুপায়, তারাই শুধু এগুলো মোবাইল ফোনে ডাউনলোড করে রাখে। আমি নিজেও একজন ‘ইটা’ ব্যবহারকারী। সবার মতো আমিও বাধ্য হয়ে আমার মোবাইল ফোনে ‘ইটা’ কে জায়গা করে দিয়েছি। কারণ আমার ইউনিভার্সিটির সব ধরনের তথ্য এই অ্যাপের মাধ্যমে দেওয়া হয়।
ইউনিভার্সিটির সব বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য এই অ্যাপটি থাকা একরকম বাধ্যতামূলক। আর এটাই হলো ইরান সরকারের একটা বড় খেলা। নিজ দেশের নাগরিক তো বটে, বাইরে থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের দিয়েও নিজেদের প্রযুক্তি অভ্যস্ত করাতে চাইছে। এভাবেই একের পর এক বুদ্ধির খেলা দেখিয়ে ইরান সারা বিশ্বে নিজেদের একটি প্রভাববলয় তৈরি করতে চাইছে, বিশেষ করে প্রযুক্তিতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, স্নাতকোত্তর, ভাষাতত্ত্ব, আল-যাহরা ইউনিভার্সিটি, তেহরান, ইরান