শীতকাল বাংলাদেশের ঋতুচক্রের অন্যতম সৌন্দর্যময় একটি অধ্যায়। এই ঋতু প্রকৃতিকে যেমন এক অনন্য রূপে সাজিয়ে তোলে, তেমনি মানুষের জীবনে নিয়ে আসে নতুন এক অভিজ্ঞতা। শীতের আগমনে গ্রামীণ জীবন যেন আরো জীবন্ত হয়ে ওঠে। খেজুরগাছের রস সংগ্রহ, নবান্নের উত্সব, পিঠাপুলির আয়োজন—সব মিলিয়ে শীতকাল বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঠান্ডা বাতাস, শিশিরমাখা সবুজ ঘাস এবং কুয়াশার চাদরে মোড়ানো সকাল প্রকৃতির এক মনোমুগ্ধকর ছবি আঁকে। কিন্তু এই ঋতুর একটি অন্যরূপও রয়েছে, যা বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষ এবং পরিবেশের জন্য নানামুখী চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে।
একসময় শীতকাল ছিল সবার কাছে আরামদায়ক এবং শান্তিপূর্ণ। গ্রামের কৃষকদের জন্য এটি ছিল ফসল কাটার মৌসুম। ধান কাটা, সরিষার ফুলের হলুদ আভা এবং আলু বা অন্যান্য শীতকালীন সবজির উত্পাদন গ্রামের অর্থনীতি ও জীবনে প্রভাব ফেলত। শীতকালীন জলবায়ু কৃষিকাজের জন্য ছিল অত্যন্ত উপযোগী। পাশাপাশি গৃহপালিত পশুপাখিও শীতকালের এই ঠান্ডা পরিবেশে সহজেই মানিয়ে নিতে পারত।
গত কয়েক দশকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীতকালের চিরাচরিত রূপ বদলে গেছে। শীতের সময়কাল ছোট হয়ে আসছে আর তীব্রতা কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে। একদিকে যখন দেশের কিছু অঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহ তীব্র হয়, অন্যদিকে দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী শীতের অভাব দেখা দেয়। এর ফলে কৃষির উত্পাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শীতকালীন শস্য উত্পাদনের সময় তাপমাত্রার অস্বাভাবিক ওঠা-নামা কৃষকদের জন্য নতুন সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
উত্তরাঞ্চলের জেলা যেমন রংপুর, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর এবং ময়মনসিংহের কিছু অঞ্চল শীতের কনকনে ঠান্ডায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব এলাকায় তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার নিচে নেমে আসে, যা সাধারণ মানুষের জন্য সহ্য করা কঠিন। প্রান্তিক মানুষ, বিশেষত যাদের পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র নেই, তারা শীতকালে ব্যাপক কষ্ট ভোগ করে। বৃদ্ধ ও শিশুরা ঠান্ডাজনিত রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, এবং শ্বাসকষ্টের মতো রোগ শীতকালে সাধারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শীতকালীন সময় শুধু গ্রামীণ জনজীবন নয়, শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্যও দুঃসহ। বিশেষ করে পথশিশু এবং গৃহহীন মানুষের জন্য শীত একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তারা ঠান্ডায় কাঁপতে থাকে এবং অনেক সময় শীতের কারণে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। শীতকালীন তাপমাত্রার এই ওঠা-নামা দেশের শ্রমজীবী মানুষ যেমন দিনমজুর, রিকশাচালক এবং হকারদের আয়ের ওপরও প্রভাব ফেলে। ঠান্ডার কারণে তারা কাজ করতে পারছে না, ফলে তাদের জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
শীতের প্রভাব পরিবেশ এবং প্রাণীকুলের ওপরও পড়ে। বন্যপ্রাণী, বিশেষত পাখি এবং ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীরা এই সময় খাবারের সংকটে পড়ে। গৃহপালিত পশুপাখি যেমন কুকুর-বিড়ালও ঠান্ডার কারণে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। ঠান্ডায় যথাযথ খাবার ও আশ্রয়ের অভাবে অনেক প্রাণী মারা যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শীতকালে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অতিরিক্ত শৈত্যপ্রবাহ এবং তাপমাত্রার অস্বাভাবিকতা পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর ফলে শুধু প্রান্তিক মানুষ নয়, বরং কৃষি, প্রাণীকুল এমনকি দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন সচেতনতা এবং সমন্বিত উদ্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোর জন্য কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে এবং পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গাছ লাগানো, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং শিল্পদূষণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা সম্ভব।
প্রান্তিক মানুষের জন্য সহায়তা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। শীতবস্ত্র বিতরণ, অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা এবং শীতকালীন চিকিত্সাসেবা নিশ্চিত করা দরকার। স্থানীয় প্রশাসন এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শীতকালকে মানুষের জন্য আরামদায়ক এবং প্রাণীকুলের জন্য নিরাপদ করার জন্য সরকারের পাশাপাশি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
শীতকাল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত সংকটগুলোকে অবহেলা করা যাবে না। সঠিক পরিকল্পনা এবং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে শীতকালকে সবার জন্য একটি সুখকর সময় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এটি শুধু মানুষের জন্য নয় বরং সমগ্র পরিবেশ এবং প্রাণীকুলের জন্যও একটি ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনবে।
লেখক : গাজীপুর থেকে