বিশ্বের মানচিত্রে ছোট্ট একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইতিমধ্যে বাংলাদেশের পরিচিতি বিশ্ববাসীর কাছে নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগোলিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কোনো দিক থেকেই এই দেশকে এখন অবহেলা করার অবকাশ নেই। এর অন্যতম যৌক্তিক কারণ হচ্ছে, এ দেশের বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম জনসংখ্যা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে যেখানে চিকিত্সা বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে, সেখানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কাজ করতে সক্ষম এমন ব্যক্তিদের সংখ্যা ঈর্ষণীয়। এটি যেমন একদিকে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক, অন্যদিকে এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আবার বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত, যারা তাদের উত্পাদনশীলতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পেরে দিন দিন হতাশার সমুদ্রে নিমজ্জিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস বা বিবিএসের পরিসংখ্যানে বর্তমানে এ দেশে ২৬ লাখ ব্যক্তি বেকার, যাদের মধ্যে ২১.৪৬ লাখের বয়সসীমা ১৫ থেকে ২৯ বছর, যা মোট জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের ৬৮ লাখ লোকের উত্পাদনক্ষমতা অব্যবহূত থেকে যায়, যার মধ্যে ১৩.১৮ শতাংশ রয়েছে ডিগ্রিধারী। আর সিপিডির মতে বাংলাদেশে ১২ লাখ ব্যক্তি সরকারি চাকরি করে। একথা বলার কারণ হলো, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান মনে করে সরকারি চাকরিতে ২০১৫ সালের পে স্কেল ঘোষণার কারণে বেসরকারি চাকরির প্রতি মানুষের ঝোঁক কমিয়ে দিয়েছে। এই পারিসংখ্যানিক চিত্র তুলে ধরার মূল কারণ হলো, বর্তমানে সময় এসেছে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের জনমিতিক অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কর্মক্ষেত্রের প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আর এই কর্মক্ষেত্রের এক বিশাল সম্ভাবনাময় পেশা হতে পারে কেয়ারগিভার।
কেয়ারগিভিং হলো কোনো ব্যক্তিকে কার্যকর কৌশল বা উপায়ে সেবা প্রদানের এক ধরনের সেবামূলক ব্যবস্থা বা কার্যক্রম। যিনি এই দায়িত্ব পালন করেন, তাকে বলা হয় কেয়ারগিভার। একজন চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্রই শেষ কথা নয়। রোগীর সুস্থতা বা দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায়, বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তিদের সার্বক্ষণিক দেখাশোনায় যাবতীয় সব কাজের দায়িত্ব পালন করেন একজন কেয়ারগিভার। বাংলাদেশে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন ব্যুরোর মাধ্যমে টেকনিক্যাল এডুকেশন বোর্ড কেয়ারগিভিং কোর্সের ডিজাইন করেছে। কিন্তু এখনো বাংলাদেশে এই পেশার সূচনা সেভাবে লক্ষ করা যায় না।
কেয়ারগিভার সম্পর্কে কমবেশি সবাই, বিশেষ করে নাগরিক ব্যস্ত জীবনের অভ্যস্ততায় থাকা মানুষ দিন দিন উপলব্ধি করছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উন্নত বিশ্বে বৃদ্ধ ব্যক্তিরা বৃদ্ধাশ্রমে যেতে চায় শুধু কেয়ারগিভিং সেবা পাওয়ার জন্য। বাংলাদেশে আমরা হাসপাতালে ভর্তি হলে কেয়ারগিভার খুঁজতে থাকি। এছাড়া যাদের পরিবারে বেড রিডেন পেশেন্ট, ডিমেনশিয়া, প্যারালাইজড বা শারীরিক অক্ষম রোগী, অটিজম আক্রান্ত শিশু বা বয়স্ক ব্যক্তি আছেন, তাদের কাছে কেয়ারগিভার কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আশপাশের গড়ে ওঠা কেয়ারগিভিং প্রতিষ্ঠানের চাহিদা থেকেই বোঝা যায়। একজন দক্ষ কেয়ারগিভারের মাসিক আয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার নিচে নয়। মাত্র ছয় মাসের একটি ট্রেনিং নিয়ে একজন ব্যক্তি চাকরির পেছনে না ছুটে এই স্বেচ্ছাব্রতী পেশায় সত্ভাবে আয় করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এই পেশায় রয়েছে আন্তরিকতা ও ভালোবাসার চাক্ষুষ প্রশান্তি ও প্রতিদান। যারা বেশি দূর লেখাপড়া করতে আগ্রহী নয়, বা বিদেশে লেবার হিসেবে যেতে চায়, তাদের জন্য এই পেশাটি অপূর্ব সুযোগ হতে পারে।
২০১৮ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী এই পেশার চাহিদা এতটাই বেড়েছে যে, উন্নত বিশ্ব থেকে কেয়ারগিভারের সুবিধা ও সম্মান ক্রমশ বেড়েই চলেছে। শুধু জাপান থেকেই ২০৩০ সালের মধ্যে ৬০ লাখ কেয়ারগিভার নেওয়া হবে বলে জানা যায়। উন্নত দেশ ছাড়াও সৌদি আরব, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কেয়ারগিভারের প্রচুর চাহিদার কারণে যেখানে ভারত, ফিলিপাইন থেকে কাজ করতে যায়, সেখানে আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা কত কষ্ট করে অল্প টাকায় ক্লিনার বা অন্যান্য কাজ করে অর্থ আয় করে থাকে। অথচ ছয় মাসের ট্রেনিং করে প্রশিক্ষিত হয়ে গেলে একজন লেবারের থেকে তিন গুণ বেশি বেতনে সম্মানজনক এই পেশায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চাকাকে অনেক মজবুত করে দিতে পারবে।
স্বেচ্ছাব্রতী এমন একটি সম্মানজনক পেশা বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে একদিকে যেমন আয়ের সুযোগ করে দেবে, অন্যদিকে সুস্থ ও সুন্দর সামাজিক মূল্যবোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই নবদিগন্তের সূচনায় এই পেশা নিয়ে সুশীল সমাজকে গভীরভাবে ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক (সমাজকর্ম), বিসিএস সাধারণ শিক্ষা