বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ, যেখানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি বছর লক্ষাধিক শিক্ষার্থী প্রথাগত শিক্ষা সম্পন্ন করলেও, তারা যথাযথ কর্মসংস্থানের সুযোগ পায় না। এই পরিস্থিতি দেশের আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এই সমস্যা মোকাবিলায় কর্মমুখী শিক্ষা একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। কর্মমুখী শিক্ষা এমন একটি প্রক্রিয়া, যা শিক্ষার্থীদের শুধু প্রথাগত শিক্ষা নয়, বরং পেশাকেন্দ্রিক দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করে। এটি শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে এবং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশের বেকার সমস্যার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো শিক্ষাব্যবস্থা ও আধুনিক শ্রমবাজারের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীনতা। প্রচলিত প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা সাধারণত তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রদান করে, যা বাস্তবক্ষেত্রে কাজে লাগানোর সুযোগ কম। ফলস্বরূপ, উচ্চ শিক্ষাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কর্মসংস্থানের অভাব দেখা দেয়। কর্মমুখী শিক্ষা এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে, কারণ এটি শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে কাজ শেখায়। যেমন—প্রযুক্তিগত দক্ষতা, সেলাই, কারুশিল্প, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, আইটি প্রশিক্ষণ ইত্যাদি। এই ধরনের শিক্ষা তাদের নিজেদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগও করে দেয়।
দেশের অধিকাংশ জনগণ গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করে এবং তাদের জীবিকা কৃষি বা ক্ষুদ্রশিল্পের ওপর নির্ভরশীল। কর্মমুখী শিক্ষা তাদের এই খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতা প্রয়োগের সুযোগ দেয়। পাশাপাশি, দেশে তৈরি পোশাকশিল্প, আইটি সেক্টর এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের চাহিদা পূরণে দক্ষ কর্মী গড়ে তোলাও সম্ভব। কর্মমুখী শিক্ষা শুধু চাকরির ক্ষেত্রেই নয়, বরং স্বাধীনভাবে কাজ করার মানসিকতাও তৈরি করে। এটি তরুণদের আত্মনির্ভরশীল হতে উদ্বুদ্ধ করে এবং তাদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ জাগায়। উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করলে তারা নিজেরা যেমন আয়ের পথ খুঁজে পায়, তেমনি অন্যদের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
সরকার ইতিমধ্যে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন—কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালু করা ও যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। তবে এই উদ্যোগগুলোকে আরো কার্যকর করতে হলে, শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শিল্পক্ষেত্রের প্রয়োজনীয়তার সমন্বয় ঘটাতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষা তরুণ সমাজকে শুধু অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলে না, বরং তাদের আত্মবিশ্বাসও বৃদ্ধি করে। এটি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সামাজিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করে। কারণ বেকারত্বের ফলে সৃষ্ট সামাজিক সমস্যা যেমন—অপরাধপ্রবণতা, মাদকাসক্তি ও হতাশা অনেকাংশে হ্রাস পেতে পারে।
কর্মমুখী শিক্ষা বাংলাদেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণে এক অমূল্য হাতিয়ার। এটি শুধু কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে না, বরং একটি আত্মনির্ভরশীল, দক্ষ ও উন্নয়নমুখী জাতি গঠনে সহায়তা করে। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মমুখী শিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
লেখক : শিক্ষার্থী, চায়না ওয়েস্ট নরমাল ইউনিভার্সিটি, চীন