মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা প্রথম বাংলাদেশি নারী নিশাত মজুমদারকে আমি বহুদিন ধরেই চিনি। আমাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল যখন তিনি তার দলের একটি অভিযানের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছিলেন। সেখান থেকেই আমি তার কাজকে আরো কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। নিশাত শুধু নিজের জন্য নয়, বরং তার প্রতিটি অভিযানে যুবসমাজ ও নারীদের অন্তর্ভুক্ত করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার লক্ষ্য কেবল পাহাড় জয় করা নয়। তিনি চ্যালেঞ্জ জানাতে চান সমাজে প্রচলিত বাধা-বিপত্তিকে। তিনি বিশ্বাস করেন, আমাদের দেশের নারীরা শুধু দৈনন্দিন কাজে নয়, বরং বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং কাজগুলোতেও নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে।
২০১৮ সালে আমরা একটি প্রকল্পে একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। সেই প্রকল্প ছিল নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে এমন রোল মডেলদের নিয়ে। তখন নিশাত বলেছিলেন, তার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হচ্ছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বেগম রোকেয়া ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে একটি বৈপ্লবিক বিজ্ঞান-কল্পকাহিনি লিখেছিলেন। এই কাহিনি শুধু গল্প নয়; এটি একটি নারীবাদী আন্দোলনের সূচনা। সম্প্রতি, এই অসাধারণ লেখাটি UNESCO-এর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ তালিকায় স্থান পেয়েছে। নিশাত মজুমদার ও তার দলের বর্তমান অভিযানটিও বেগম রোকেয়ার সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ। তারা নেপালের লাংটাং অঞ্চলে একটি ঐতিহাসিক অভিযানে অংশ নিচ্ছেন। এই অভিযানটি ‘সুলতানা’স ড্রিম আনবাউন্ড’ নামে পরিচিত। তাদের লক্ষ্য হিমালয়ের তিনটি পর্বতশৃঙ্গ ‘নায়া কাং’, ‘ব্যাডেন পাওয়েল’, ও ‘ইয়ালা পিক’ জয় করা। এই তিনটি শৃঙ্গেরই উচ্চতা ৫ হাজার ৫০০ মিটারের বেশি।
এই যাত্রা বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ, কারণ এতে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন পেশা ও অভিজ্ঞতার নারীরা। দলে আছেন একজন হিসাবরক্ষক, একজন গবেষক, একজন উদ্যোক্তা, একজন ক্রীড়া শিক্ষক ও বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করা একজন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে কেউ অভিজ্ঞ পর্বতারোহী, আবার কেউ প্রথম বারের মতো এমন একটি অভিযানে যোগ দিয়েছেন। এটি আমাদের দেখায়, মানুষ যখন একসঙ্গে কাজ করে, তখন কিছুই অসম্ভব নয়। ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এর মতোই, এই দলটির অভিযাত্রা একটি বড় বার্তা দেয়। সেটি হলো— নারীরা নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে পেছনে ফেলে একে অন্যের সহযোগিতায় জীবনের নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।
আমাদের সমাজে পর্বতারোহণ একটি কঠিন এবং দুঃসাহসিক কাজ হিসেবে পরিচিত। এটি শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিক দিক থেকেও অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশি নারীদের জন্য এটি আরো কঠিন, কারণ তাদের পথে প্রযুক্তিগত জটিলতার পাশাপাশি সামাজিক বাধাগুলোও বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই মনে করেন, নারীরা এমন দুঃসাহসিক কাজে দক্ষ হতে পারে না। কিন্তু নিশাত ও তার দল সেই ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছেন। তারা প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে প্রমাণ করছেন, নারীরা সব ক্ষেত্রেই পুরুষদের সমান এবং কখনো কখনো তাদের থেকেও এগিয়ে। এই অভিযাত্রী দলটি শুধু পাহাড়ে আরোহণ করছে না; তারা দেখাচ্ছে, যখন নারীদের স্বপ্ন দেখার সুযোগ এবং সেই স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করা হয়, তখন তারা যে কোনো বাধা অতিক্রম করতে পারেন।
‘হার স্টোরি ফাউন্ডেশন’-এ আমরা এমন নারীদের গল্প তুলে ধরি, যারা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। নিশাত মজুমদার ও তার দল ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এর চেতনাকে নিজেদের কাজের মাধ্যমে জীবন্ত করে তুলছেন। তারা আমাদের দেখাচ্ছেন, নারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিলে তারা নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন।
যখন এই নারীরা লাংটাংয়ের শিখরে আরোহণ করছেন, তারা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্বপ্ন এবং তার কাজের বৈশ্বিক স্বীকৃতিকে সম্মান জানাচ্ছেন। তারা শুধু পর্বতশৃঙ্গ জয় করছেন না; বাংলাদেশের নারীরা কীভাবে বাধা ভেঙে নিজেদের প্রতিভা দিয়ে দুনিয়াকে চমকে দিতে পারে সেটা দেখিয়ে দিচ্ছেন। এই অভিযান নারী-পুরুষের সমতার জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা। অভিযানটি প্রমাণ করছে— দৃঢ় সংকল্প, সহযোগিতা ও সুযোগ পেলে কোনো স্বপ্নই অধরা নয়।
লেখক : চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং ‘হার স্টোরি ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা
এই লেখার সম্পূর্ণ দায়ভার লেখকের নিজের; দৈনিক মূলধারা এটি জনসমক্ষে তুলে ধরছে মাত্র । এর সঙ্গে দৈনিক মূলধারা কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়। ফলে এ-সংক্রান্ত কোনো দায়-দায়িত্ব মূলধারা বা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত কেউই বহন করবে না।