বর্তমানে দেশ একটি চরম সংকটময় সময় পার করতেছে। বিশেষ করে দেশের চলমান আইন ব্যবস্থার কথা না বললেই নয়। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, যে দল ক্ষমতায় থাকে সেদলই তার প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য আইনের যাচ্ছেতাই অপব্যবহার করে আসছে।
৫ই আগস্ট ছাত্রজনতার এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী শাসনের অবসান ঘটলেও দেশের চলমান আইন ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। দেশে যততত্র ঢালাও মামলার প্রবনতা এখনো রয়ে গেছে। যদিও এসকল মামলার অধিকাংশই মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এই বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দায়েরকৃত এসব ঢালাও ও গায়েবি মামলা সরকারের জন্য বিব্রতকর।
কোনো একটা হত্যা মামলায় নিদিষ্ট কয়েকজনের নাম উল্লেখ্যের পাশাপাশি হাজার হাজার মানুষকে মামলায় জড়ানো হচ্ছে কেবল অজ্ঞাত হিসেবে। এর ফলে বেশ কিছু সামাজিক প্রভাব স্পষ্টভাবে লক্ষনীয় হয়ে উঠেছে। যেমনঃ
আইন ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা
দেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, সম্প্রতি মাত্র ২৬৮টি ফৌজদারি মামলায় ১ লক্ষ ৯৪ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। যার মধ্যে ২৬ হাজার ২৬৮ জনের নাম উল্লেখ্য আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এর মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ৬৮ হাজার ৫৫ জনই হচ্ছে অজ্ঞাত আসামী। মূলত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসকল গায়েবি মামলার উদ্দেশ্য থাকে অর্থ বানিজ্য ও ভিন্নমত দমন। যার ফলে আইন ব্যবস্থার প্রতি জনসাধারণের অনাস্থা তৈরি হচ্ছে।
বিচার ব্যবস্থার উপর চাপ
২০২৪ এর ফেব্রুয়ারী মাসে দেশের একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে, বর্তমানে দেশে প্রায় ৪২ লক্ষ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তার উপর নতুন করে হাজার হাজার ব্যক্তির নামে গায়েবি মামলা দেয়া হচ্ছে। যার ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাচ্ছে। যখন বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘকালীন বা অযৌক্তিকভাবে চাপানো মামলা দ্বারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন সাধারণ মানুষের বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমে যায়। এতে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যেতে পারে।
গণতন্ত্রের জন্য হুমকি
কোনো একটা মামলাকে কেন্দ্র করে ঢালাও ভাবে হাজার হাজার মানুষকে অজ্ঞাতনামা হিসেবে মামলায় জড়ানো একটি সুষ্ঠু গনতান্ত্রিক দেশের আইন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসকল মামলার মূল উদ্দেশ্যই থাকে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হয়রানি। সেক্ষেত্রে, ক্ষমতার পালাবদলের সাথে গায়েবি মামলার ধারাবাহিকতাও অব্যাহত থাকে।
এছাড়াও হয়নানির উদ্দেশ্যে এসকল মামলা মানুষের অর্থনৈতিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। মামলা চলাকালীন সময়ে নানা ধরণের মানসিক চাপ ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়, যা ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
বর্তমানে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলোও এ নিয়ে প্রশ্ন উঠানো শুরু করেছে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যায়বিচার জরুরি। ঢালাও মামলা বা মিথ্যা অভিযোগের কারণে কখনো কখনো ন্যায় বিচারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। এটি সাধারণ মানুষের অধিকার এবং স্বাধীনতাকে খর্ব করে এবং গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে। এ প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন বলেন, ‘যখন বিচার ব্যবস্থায় ঢালাও মামলা হয়, তখন রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি ধ্বংস হয়।’
সুতরাং, এসকল ঢালাও মামলা কমানোর জন্য আইন সংশোধন, বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ, আইনশৃঙ্খলা সংস্কার, তদন্তে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, বিশেষ আদালতের সৃষ্টি এবং সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে এর পরিবর্তন আনা জরুরি।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়