প্রতিদিন মাগরিবের পর বয়স্ক-যুবাদের আঠারো জনের একটি টিমকে কুরআন সহ দীনের মৌলিক বিষয়াদি পড়াই। যেহুতু দীনিয়াতের সিলেবাস পড়াই তাই প্রত্যেকের বইয়ে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের লিস্ট আছে। এ হিসেবে ক্লাসের সবারই দৈনিক নামাজের হিসাব দিতে হয়। পড়লে টিকচিহ্ন, না পড়লে ক্রস। ক্লাসের নিয়মিত মুসল্লীদের একজন লিয়ন মোল্লা। সবসময় প্রথম কাতারেই থাকে। কিন্তু ঘটনাচক্রে একদিন সে যোহর আর আসরের হিসাব দিতে ব্যর্থ হয়। জিজ্ঞেস করলাম নামাজ পড় নি কেন? বলল, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রোর কুশপুত্তলিকা বানাতে যেয়ে যোহর মিস হয়ে গেছে। আর নবীজীর জন্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে মিছিলে গিয়েছিলাম তাই আছর পড়তে পারিনি! আমি জোরে বলে উঠলাম- “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”- এ কি বললে লিয়ন?! নবী প্রেম দেখাতে যেয়ে স্বয়ং নবীজীর আজন্মের প্রচারিত দাওয়াতের মেজাজকে দলিত মথিত করলে? এ কেমন নবী প্রেম? এই প্রেমের জন্য আমরা আদিষ্ট? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান আদর্শের সাথে এত বড় ধোঁকাবাজি? লিয়ন! তোমার আমার এই ন্যাকামো নবীপ্রেম কিন্তু আমাদের জান্নাতে নিতে পারবেনা বরং আবু লাহাবের সাক্ষাৎ করিয়ে দিবে।
প্রিয় পাঠক! প্লীজ, একবার কি ভেবে দেখবেন আমরা কোন সমাজে,কোন মেজাজে বেড়ে উঠছি? বড্ড আফসোস! আজ আমরা দ্বীনের মৌলিক চেতনা থেকে যোজন যোজন মাইল দুরে সরে এসেছি। মনগড়া জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আজ যদি কেউ আমাদের মৌলিক দীনের কথা বলে তখন আমরা তাকে সঙ্গে সঙ্গে এবাউট করি,ইহুদি খৃষ্টানদের দালাল বলে দুরে সরিয়ে দিই। আর আমরা চলি আমাদের সাজানো নিজস্ব স্টাইলের দ্বীনে যার সাথে মদীনার কোন যোগসূত্র নেই। বড় পরিতাপের বিষয় হল, এই চিত্র শুধু এই দেশের নয় বরং সারা দুনিয়াটাই আজ লিয়নদের মতো শটকার্ট মোল্লাদের দখলে। এদের ভাবখানা হচ্ছে এমন যে, আমরা কুশপুত্তলিকা বানাতে যেয়ে যোহর পড়ব না ঠিক কিন্তু কেউ যদি ভাস্কর্য বানাতে যায় তার সাথে সরাসরি জিহাদের ঘোষণা দিব,মিছিল করব, সমাবেশ করব। সমাবেশে যেয়ে আছর মাগরিব এশা বাদ দিব তবুও এ জিহাদ চালিয়েই যাব ইনশাআল্লাহ। যদিও উভয়টিই ইসলাম সমর্থিত নয়। মিথ্যা বলা হারাম। সবখানে একই বয়ান চালিয়ে যাব কিন্তু কারো সাথে যদি আদর্শিক মতানৈক্য হয় তাহলে মনগড়া মিথ্যা বলতেই থাকব, বলতেই থাকব।
পাঠক! উপরের কোনটিই কি শরিয়ত সম্মত? নিশ্চয়ই না। কিন্তু আমি নিজে একটা ভুল করলে সেটাকে ইনিয়ে বিনিয়ে জায়েজ বানাতে দিন-রাত একাকার করে ফেলি আর যখন অন্যের পালা আসে তখন চোখ বন্ধ করে না জায়েজ ফতোয়া দিয়ে দিই। আজ এই মানসিকতা নিয়েই আমরা ইসলামের হেফাজত করতে চাই। যদিও ইসলামের মৌলিক শিক্ষা আমি আমার সাড়ে তিন হাত বডিতে ফিট করতে চাই না, চাই না, চাই না! ইমান, ইবাদাত, মু’আমালাত, মু’আশারাত; আমার জীবনে কোন কিছুরই আগামাথা নেই তবুও আমার ইসলাম হেফাজত করা চাই, চাই চাই-ই।
মুমিন একই গর্তে দু’বার পা দেয় না কিন্তু আমরা সোশ্যাল যুগের নব্য আশেকে রাসূল এতটা নির্লজ্জ যে, একই গর্তে পা দিতে দিতে পা’টা ভেঙে গর্তে থেকে যাবে তারপরও আমরা উত্তর গেইটে দাঁড়িয়ে হৈচৈ করতেই থাকব,করতেই থাকব! কারণে অকারণে বারবার পুলিশের হাতে ধাঁওয়া খেলে যে ইজ্জত নিয়ে টান দেয়, জনমনে একটা ঘৃণ্যতার ছাপ ফেলে সেটা না বুঝে উল্টো প্রশাসনকে বদদোয়া দিতেই থাকব, দিতেই থাকব। আপন আদালতে বিচার করে তাদেরকে টেনে হেঁচড়ে জাহান্নামে ফেলে আসব (?) অথচ আমরা ভালো করেই জানি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন মুসলমান তো দুরের কথা কোন কাফেরকে পর্যন্ত বদদোয়ার অভিশাপ দেননি! আজ যখন আমাদের ভুলের কারণে ক্ষমতাসীন দলের কোন নেতা শাপলা চত্বরের ঘটনায় আমাদের শেয়ালের সাথে তুলনা দেয় তখন কিন্তু আমাদের মুখ থাকে না অথচ আমরা আবারও নির্লজ্জের মতো সেই শাপলায় ফিরে যেতে চাই!
পরিশেষে, হে প্রিয় আশেকে রাসূল! শুনুন, আপনাকেই বলছি। হযরত আবু বকর, ওমর,উসমান, আলী সহ সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম (রিযওয়ানুল্লাহি তা’আলা আলাইহিম আজমাঈন) হচ্ছেন সাচ্চা আশেকে রাসূল। রাসূল প্রেমে তাঁদের চেয়ে উন্নিত আর কে হতে পারে? তাঁদের সময় ইসলাম ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ শিখরে সুতরাং নূন্যতম একবার হলেও তাদের জীবনীগ্রন্থ পড়ুন সে আলোকেই জীবন গড়ার পরিকল্পনা হাতে নিন। যেখানে সেখানে হুংকার দিলেই দাওয়াতের হক্ব আদায় হবে না বরং গাফেল মুসলমানদের মাঝে দাওয়াতের প্রচার, প্রসার ঘটাতে হবে ‘উদ’য়ু ইলা সাবিলি রব্বিকা বিল হিকমাহ’র আলোকে। তবেই শত্রু হবে বন্ধু, বেদ্বীন হবে দ্বীনদার, আঁধার কেটে হাসবে প্রভাত রবি। অন্যথায় শত্রু বাড়তেই থাকবে,বাড়তেই থাকবে। হাত বাড়ালেই দেখবেন শত্রু আর শত্রু। আবার এরা কুরাইশী যুগের শত্রু নয় বরং আপনার শত্রুরা নিয়মতান্ত্রিক নামাজ পড়ে,যাকাত দেয়, হজ্ব করে, কুরআন শিখে! কিন্তু শত্রু হল কিভাবে? ঐই যে আপনার হিকমত, প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতার অভাব। তাই আপনি আপনার মুসলিম ভাইদেরকেই শত্রু জ্ঞান ভাবা শুরু করে জাহান্নামে ঠেলে ঠেলে পাঠাতে নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন! ‘ইয়া আসাফা আলা নাফসি’।
সবশেষে, সোশ্যাল যুগের নব্য আশেকে রাসূলদের শুভ বোধের উন্মেষ ঘটুক এই প্রত্যাশা-ই করি।
লেখকঃ মুহাম্মাদ আইয়ুব। শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।